আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়ঃ ইউক্লিডের স্বীকার্য। এটি নবম – দশম শ্রেনী গণিতের রেখা, কোণ ও ত্রিভুজ এর অন্তর্গত।
ইউক্লিডের স্বীকার্য (Euclid’s Postulates )
উপরে তল, রেখা ও বিন্দু সম্পর্কে যে ধারণা দেওয়া হলো, তা তল, রেখা ও বিন্দুর সংজ্ঞা নয় বর্ণনা মাত্র। এই বর্ণনায় মাত্রা বলতে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা ইত্যাদি ধারণা ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলো সংজ্ঞায়িত নয়। ইউক্লিড তাঁর ‘Elements’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের শুরুতেই বিন্দু, রেখা ও তলের যে সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন তা-ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে অসম্পূর্ণ। ইউক্লিড প্রদত্ত কয়েকটি বর্ণনা নিম্নরূপ : –
১. যার কোনো অংশ নাই, তাই বিন্দু।
২. রেখার প্রান্ত বিন্দু নাই ।
৩. যার কেবল দৈর্ঘ্য আছে, কিন্তু প্রস্থ ও উচ্চতা নাই, তাই রেখা।
৪. যে রেখার উপরিস্থিত বিন্দুগুলো একই বরাবরে থাকে, তাই সরলরেখা।
৫. যার কেবল দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আছে, তাই তল।
৬. তলের প্রান্ত হলো রেখা।
৭. যে তলের সরলরেখাগুলো তার ওপর সমভাবে থাকে, তাই সমতল।
লক্ষ করলে দেখা যায় যে, এই বর্ণনায় অংশ, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, সমভাবে ইত্যাদি শব্দগুলো অসংজ্ঞায়িতভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। ধরে নেয়া হয়েছে যে, এগুলো সম্পর্কে আমাদের প্রাথমিক ধারণা রয়েছে। এসব ধারণার উপর ভিত্তি করে বিন্দু, সরলরেখা ও সমতলের ধারণা দেওয়া হয়েছে। বাস্তবিক পক্ষে, যেকোনো গাণিতিক আলোচনায় এক বা একাধিক প্রাথমিক ধারণা স্বীকার করে নিতে হয়। ইউক্লিড এগুলোকে স্বতঃসিদ্ধ (axioms) বলে আখ্যায়িত করেন। ইউক্লিড প্রদত্ত কয়েকটি স্বতঃসিদ্ধ:
১. যে সকল বস্তু একই বস্তুর সমান, সেগুলো পরস্পর সমান।
২. সমান সমান বস্তুর সাথে সমান বস্তু যোগ করা হলে যোগফল সমান।
৩. সমান সমান বস্তু থেকে সমান বস্তু বিয়োগ করা হলে বিয়োগফল সমান।
৪. যা পরস্পরের সাথে মিলে যায়, তা পরস্পর সমান।
৫. পূর্ণ তার অংশের চেয়ে বড়।

আধুনিক জ্যামিতিতে বিন্দু, সরলরেখা ও সমতলকে প্রাথমিক ধারণা হিসাবে গ্রহণ করে এদের কিছু বৈশিষ্ট্যকে স্বীকার করে নেওয়া হয়। এই স্বীকৃত বৈশিষ্ট্যগুলোকে জ্যামিতিক স্বীকার্য (postulate) বলা হয়। বাস্তব ধারণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এই স্বীকার্যসমূহ নির্ধারণ করা হয়েছে। ইউক্লিড প্রদত্ত পাঁচটি স্বীকার্য হলো:
স্বীকার্য ১. একটি বিন্দু থেকে অন্য একটি বিন্দু পর্যন্ত একটি সরলরেখা আঁকা যায়।
স্বীকার্য ২. খণ্ডিত রেখাকে যথেচ্ছভাবে বাড়ানো যায়।
স্বীকার্য ৩. যেকোনো কেন্দ্র ও যেকোনো ব্যাসার্ধ নিয়ে বৃত্ত আঁকা যায়।
স্বীকার্য ৪. সকল সমকোণ পরস্পর সমান ।
স্বীকার্য ৫. একটি সরলরেখা দুইটি সরলরেখাকে ছেদ করলে এবং ছেদকের একই পাশের অন্তঃস্থ কোণদ্বয়ের সমষ্টি দুই সমকোণের চেয়ে কম হলে, রেখা দুইটিকে যথেচ্ছভাবে বর্ধিত করলে যেদিকে কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের চেয়ে কম, সেদিকে মিলিত হয়।
ইউক্লিড সংজ্ঞা, স্বতঃসিদ্ধ ও স্বীকার্যগুলোর সাহায্যে যুক্তিমূলক নতুন প্রতিজ্ঞা প্রমাণ করেন। তিনি সংজ্ঞা, স্বতঃসিদ্ধ, স্বীকার্য ও প্রমাণিত প্রতিজ্ঞার সাহায্যে আবার নতুন একটি প্রতিজ্ঞাও প্রমাণ করেন। ইউক্লিড তার ‘ইলিমেন্টস’ গ্রন্থে মোট ৪৬৫টি শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রতিজ্ঞার প্রমাণ দিয়েছেন যা আধুনিক যুক্তিমূলক জ্যামিতির ভিত্তি।
লক্ষ করি যে, ইউক্লিডের প্রথম স্বীকার্যে কিছু অসম্পূর্ণতা রয়েছে। দুইটি ভিন্ন বিন্দু দিয়ে যে একটি অনন্য সরলরেখা অঙ্কন করা যায় তা উপেক্ষিত হয়েছে। পঞ্চম স্বীকার্য অন্য চারটি স্বীকার্যের চেয়ে জটিল। অন্যদিকে, প্রথম থেকে চতুর্থ স্বীকার্যগুলো এতো সহজ যে এগুলো ‘স্পষ্টই সত্য’ বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু এগুলো প্রমাণ করা যায় না। সুতরাং, উক্তিগুলো ‘প্রমাণবিহীন সত্য’ বা স্বীকার্য বলে মেনে নেয়া হয়। পঞ্চম স্বীকার্যটি সমান্তরাল সরলরেখার সাথে জড়িত বিধায় পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে।
আরও দেখুনঃ