আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় দৈর্ঘ্য মাপি – যা দৈর্ঘ্য মাপি এর অন্তর্ভুক্ত। গণিত হল জ্ঞানের একটি ক্ষেত্র যাতে সংখ্যা, সূত্র এবং সম্পর্কিত কাঠামো, আকার এবং সেগুলির মধ্যে থাকা স্থানগুলি এবং পরিমাণ এবং তাদের পরিবর্তনগুলি অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই বিষয়গুলি যথাক্রমে সংখ্যা তত্ত্বের প্রধান উপশাখা,বীজগণিত, জ্যামিতি, এবং বিশ্লেষণ। তবে একাডেমিক শৃঙ্খলার জন্য একটি সাধারণ সংজ্ঞা সম্পর্কে গণিতবিদদের মধ্যে কোন সাধারণ ঐকমত্য নেই।
গণিতে সংখ্যা ও অন্যান্য পরিমাপযোগ্য রাশিসমূহের মধ্যকার সম্পর্ক বর্ণনা করা হয়। গণিতবিদগন বিশৃঙ্খল ও অসমাধানযুক্ত সমস্যাকে শৃঙ্খলভাবে উপস্থাপনের প্রক্রিয়া খুঁজে বেড়ান ও তা সমাধানে নতুন ধারণা প্রদান করে থাকেন।গাণিতিক প্রমাণের মাধ্যমে এই ধারণাগুলির সত্যতা যাচাই করা হয়। গাণিতিক সমস্যা সমাধান সম্পর্কিত গবেষণায় বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ বা শত শত বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। গণিতের সার্বজনীন ভাষা ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা একে অপরের সাথে ধারণার আদান-প্রদান করেন। গণিত তাই বিজ্ঞানের ভাষা।
দৈর্ঘ্য মাপি
দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি কাজের সাথেই আমাদের মাপ-জোখ করতে হয়। তোমরা বাজারে গিয়ে যখন প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস যেমন: চাল, ডাল, তেল, লবণ, চিনি, রশি, বৈদ্যুতিক তার ইত্যাদি ক্রয় করো তখন দোকানদার তোমার চাহিদামতো জিনিসগুলো মেপে দেন। আর এই মাপ-জোখের বিষয়টাকেই আমরা পরিমাপ বলে থাকি। তোমরা খেয়াল করে দেখবে যে, দোকানদার সকল ধরনের জিনিসপত্র একভাবে মাপেন না। যেমন: চাল, ডাল মাপের ক্ষেত্রে যে যন্ত্র ব্যবহার করেন, দড়ি বা বৈদ্যুতিক তার মাপার সময় ঐ যন্ত্রটি ব্যবহার করেন না। আর এই সকল আদর্শ পরিমাণের সাথে তুলনা করেই আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম জিনিস পরিমাপ করে থাকি। এই আদর্শ পরিমাণটি একক নামে পরিচিত।
তোমাদের নিশ্চয়ই এখন জানতে ইচ্ছে করছে, এই পরিমাপ ব্যবস্থার প্রয়োজন হলো কেন? একটু চিন্তা করে বলো তো পরিমাপ পদ্ধতি যদি আবিষ্কার না হতো তাহলে কি দর্জি একদম সঠিক মাপে তোমার জামা তৈরি করে দিতে পারতেন? আবার পরিমাপ প্রক্রিয়া আছে দেখেই তো তুমি বলতে পারো তোমার বাড়ি থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব কত!, আরও মজার কথা কি জানো, মানব সমাজের একদম শুরু থেকেই মানুষ নানা ধরনের পরিমাপ প্রক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। পরিমাপ ব্যবস্থার সবচেয়ে পুরনো নিদর্শন পাওয়া যায় প্রাচীন মিশর, মেসোপটেমিয়া, সিন্ধু উপত্যকা এবং সম্ভবত ইলাম (ইরানে অবস্থিত) এর অধিবাসীদের মাধ্যমে। দৈর্ঘ্য পরিমাপের অতি প্রাচীন এককটি আসে এই মিশরীয় অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত একক ‘কিউবিট’ থেকে।
আমরা এখন যেভাবে ‘মিটার’ ব্যবহার করি তারা ব্যবহার করত ‘কিউবিট’। ছবিটি একটু ভালোমতো খেয়াল করে দেখলে বুঝতে পারবে মিশরীয়রা কীভাবে হাতের মাধ্যমে দৈর্ঘ্য মেপে ফেলত? সাধারণ কিউবিটের দৈর্ঘ্য ছিল বাহুর কনুই থেকে মধ্যাঙ্গুলির অগ্রভাগ পর্যন্ত। এটা আরও বিভক্ত ছিল বিঘত বা কনিষ্ঠাঙ্গুলি থেকে বৃদ্ধাঙ্গুলির মধ্যবর্তী দূরত্ব পর্যন্ত (অর্ধেক কিউবিট)।
আবার সময় মাপা হতো সূর্য, চন্দ্র এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বস্তুর পর্যায়কালের মাধ্যমে। মাটি বা ধাতুর তৈরি পাত্রের ধারণক্ষমতা মাপার দরকার হলে সেগুলো শস্যের বীজ দিয়ে পূর্ণ করে গণনা করা হতো এবং এভাবে আয়তন মাপা হতো। ওজন মাপার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হবার পর শস্য ও পাথরের ওজনকে আদর্শ বলে গণ্য করা হতো। স্বর্ণ বিক্রেতারা যে স্বর্ণ বিক্রয় করে তাতে ১৮ ক্যারেট, ২১ ক্যারেট বা ২৪ ক্যারেট লিখা থাকে। তোমরা জেনে অবাক হবে সোনা পরিমাপের ক্যারেট এককটির উদ্ভব হয়েছিল ক্যারবের বীজ থেকে। কিন্তু সমস্যা হলো সব মানুষের হাতের মাপ এক নয়; আবার সকল শস্যের বীজ একই আয়তনের হয় না।
এ সকল কারণে মানুষ মনে করল যে কোনো পরিমাপের জন্য একটি আদর্শ বা নির্দিষ্ট মাপ নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবে এ অধ্যায়ের পরবর্তী অংশে।
এবার এসো নিচের কাজটি করি।
তোমাদের শ্রেণিকক্ষটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করো। এবার শ্রেণিকক্ষটিসহ এর দরজা, জানালা, তোমাদের বসার ও বই খাতা রাখার বেঞ্চ, টেবিল, ব্ল্যাক বা হোয়াইট বোর্ড ইত্যাদির নাম ও আনুমানিক মাপ লিখে নিচের ছকটি পূরণ করো। এই কাজটি তুমি তোমার পড়ার ঘরের ক্ষেত্রেও করতে পারো। ফুট, মিটার এবং ইঞ্চি সম্পর্কে ধারণা থাকলে কাজটি তোমাদের জন্য সহজ হবে। প্রয়োজনে তোমার শিক্ষক কিংবা বাবা/মা/ বড় ভাইবোনের সাথে বিষয়গুলো আলোচনা করে নাও।
ক্রমিক নম্বর
|
যার দৈর্ঘ্য মাপা হলো তার নাম
|
আনুমানিক মাপ | |||
হাত | ফুট (feet) | মিটার (meter) | ইঞ্চি (inch) | ||
১। | |||||
২। | |||||
৩। | |||||
৪। | |||||
৫। | |||||
৬। | |||||
৭। | |||||
৮। | |||||
৯। | |||||
১০। |
ছকের আনুমানিক মাপগুলো ঠিকভাবে নির্ণয় করার জন্য তোমাদের কাছে থাকা উপকরণগুলো তুলে ধরো। উপকরণগুলোর নাম লেখো এবং উপকরণগুলো কোন কোন এককে দাগাঙ্কিত সতীর্থের সাথে বর্ণনা করো।
কাগজের স্কেল বানাই
উপকরণ: পুরাতন ক্যালেন্ডার বা মোটা কাগজ, আঠা, সেন্টিমিটার স্কেল, পেন্সিল, কাঁচি।
পদ্ধতি:
১. একটি সেন্টিমিটার বা ইঞ্চি স্কেলের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ বিবেচনায় রেখে পুরাতন ক্যালেন্ডার বা মোটা কাগজ থেকে একই মাপের দুই টুকরা কেটে নাও।
২. টুকরা দুইটিকে আঠা দিয়ে পরস্পরের সাথে লাগিয়ে দাও। তাহলে স্কেলের বডি আরও মোটা ও শক্ত হবে।
৩.এবার একই মাপের দুই টুকরা সাদা কাগজ কেটে স্কেলের বডির উভয় পাশে আঠা দিয়ে আঁটকে দাও।
8. স্কেলের বডির যেকোনো এক পাশে একটি সেন্টিমিটার বা ইঞ্চি স্কেল রেখে সেন্টিমিটার বা ইঞ্চি স্কেে লটির দাগ বরাবর তোমার পছন্দমতো বিভিন্ন রং এর কালির কলম দিয়ে দাগিয়ে নাও।
৫. সেন্টিমিটারের দাগগুলো ভিন্ন কালির কলম দিয়ে একটু লম্বা করে দাগ দাও এবং দাগের মাথায় ০, ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬……………… অঙ্ক বা সংখ্যাগুলো বসিয়ে দাও।
৬. তোমার পছন্দমতো খানিকটা ডিজাইন করে নিলেই স্কেলটি তৈরি হয়ে যাবে।
স্কুল ছুটি হওয়ায় জয়া মা-বাবার এর সাথে মামার বাড়ি বেড়াতে গেল। মামাতো ভাই অনিকের সাথে জয়ার খুব ভাব। কারণ উভয়েই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তাই সময় পেলেই নিজেদের স্কুলের গল্প করে। পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করে। বাড়ি থেকে অনিকের স্কুল কত দূরে জয়া অনিকের কাছে জানতে চায়। অনিক একটু ভেবে বলে প্রায় ৩ কিলোমিটার। জয়া মনে মনে ৩ কিলোমিটার কত দূর হতে পারে তার একটি ছবি কল্পনা করে নেয়। অনিক মাঝে মাঝে তার বাবার সাথে দরকারি জিনিসপত্র কেনার জন্য বাজারে যায়। এমনই একদিন বৈদ্যুতিক তার কেনার জন্য দোকানে গেল। দোকানদার প্রশ্ন করল কত গজ তার লাগবে? বাবা তারের পরিমাণের কথা বলার পর দোকানদার তার টেবিলে দাগানো স্কেল দ্বারা তার মেপে দিয়ে দিল।
এরপর প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য কেনার জন্য অন্য একটি দোকানে গেল। সেখান থেকে ১ কেজি ডাল, ১ লিটার তেল ও আরও কয়েক ধরনের জিনিস কিনে বাড়ি ফিরে আসল। জয়া ও অনিক উভয়ের মনেই একটি প্রশ্ন জাগে- এই দূরত্ব, তারের দৈর্ঘ্য ও অন্যান্য জিনিস মাপার ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণের সাথে তুলনা করা হয় কি? তাহলে ঐ পরিমাণকে পরিমাপের কি বলা হয়? দুজনেই মনে মনে স্থির করে স্কুলে গিয়ে শিক্ষকের সাথে কথা বলে তাদের প্রশ্নে উত্তরটি জানার চেষ্টা করবে।
যে আদর্শ ভৌত রাশির (তোমাদের বিজ্ঞান বইয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অধ্যায়ে বিভিন্ন রাশির পরিমাপ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আছে) সাথে তুলনা করে অন্যান্য রাশির পরিমাপ করা হয়, তাকে আমরা পরিমাপের একক বলে থাকি। যে কোনো পরিমাপের জন্য একটি আদর্শের প্রয়োজন রয়েছে যার সাথে তুলনা করে বিভিন্ন ভৌত রাশির পরিমাপ করা হয়। এ আদর্শকেই বলা হয় পরিমাপের একক।
দৈনন্দিন কাজকর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে প্রাচীনকাল থেকেই পরিমাপের প্রচলন ছিল। এই পরিমাপের জন্য বিভিন্ন রাশির স্থানীয় বা এলাকা ভিত্তিক বহু একক প্রচলিত ছিল। যেমন: কিছুকাল পূর্বেও আমাদের দেশে ভরের একক হিসেবে মণ, সের, ছটাক, তোলা ইত্যাদি প্রচলিত ছিল। আবার দূরত্ব নির্দেশের একক হিসেবে মাইল কিংবা দৈর্ঘ্যের জন্য গজ, ফুট, ইঞ্চি ইত্যাদি এখনো প্রচলিত আছে। স্থানীয়ভাবে হয়তোবা এখনো চলতে পারে। বিভিন্ন দেশে পরিমাপের জন্য বিভিন্ন পরিমাপ পদ্ধতি প্রচলিত থাকায় বৈজ্ঞানিক তথ্যের আদান-প্রদান ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যে নানান সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে। সেই কারণেই সারা বিশ্বে পরিমাপের একই রকম আদর্শের প্রয়োজন পড়ে। এ থেকে ১৯৬০ সালে গোটা বিশ্বে বিভিন্ন রাশির একই রকম একক চালু করার সিদ্ধান্ত হয়। এককের এ পদ্ধতিকে বলা হয় এককের আন্তর্জাতিক পদ্ধতি বা International System of Units সংক্ষেপে SI.
এ অধ্যায়ে আমরা দৈর্ঘ্য পরিমাপের একক নিয়ে আলোচনা করব। দৈর্ঘ্য পরিমাপের প্রচলিত পদ্ধতি ২টি। (১) ব্রিটিশ পদ্ধতি ও (২) মেট্রিক পদ্ধতি। ব্রিটিশ পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্য পরিমাপের একক হিসেবে গজ, ফুট, ইঞ্চি চালু আছে। তবে বর্তমানে পৃথিবীতে অধিকাংশ দেশে দৈর্ঘ্য পরিমাপে ব্যবহৃত হচ্ছে মেট্রিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে পরিমাপের বৈশিষ্ট্য হলো এটা দশগুণোত্তর। দশমিক ভগ্নাংশের দ্বারা এ পদ্ধতিতে পরিমাপ সহজে করা যায়।
আরও দেখুনঃ