বাস্তব সমস্যা সমাধানে বীজগাণিতিক সূত্র গঠন ও প্রয়োগ

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়ঃ বাস্তব সমস্যা সমাধানে বীজগাণিতিক সূত্র গঠন ও প্রয়োগ। এটি নবম – দশম শ্রেনী গণিতের বীজগাণিতিক রাশি এর অন্তর্গত।

 

বাস্তব সমস্যা সমাধানে বীজগাণিতিক সূত্র গঠন ও প্রয়োগ

 

বাস্তব সমস্যা সমাধানে বীজগাণিতিক সূত্র গঠন ও প্রয়োগ

দৈনন্দিন কাজে বিভিন্ন সময়ে আমরা বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন হই। এই সমস্যাগুলো ভাষাগতভাবে বর্ণিত হয়। এ অনুচ্ছেদে আমরা ভাষাগতভাবে বর্ণিত বাস্তব পরিবেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানকল্পে বীজগাণিতিক সূত্র গঠন এবং তা প্রয়োগ করার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। এই আলোচনার ফলে শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন বাস্তব পরিবেশে গণিতের প্রয়োগ সম্পর্কে ধারণা পাবে, অন্যদিকে নিজেদের পারিপার্শ্বিক অবস্থায় গণিতের সম্পৃক্ততা বুঝতে পেরে গণিত শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হবে।

সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি:

১. প্রথমেই সতর্কতার সাথে সমস্যাটি পর্যবেক্ষণ করে এবং মনোযোগ সহকারে পড়ে কোনগুলো অজ্ঞাত এবং কী নির্ণয় করতে হবে তা চিহ্নিত করতে হবে।

২. অজ্ঞাত রাশিগুলোর একটিকে যেকোনো চলক (ধরি x) দ্বারা সূচিত করতে হবে। অতঃপর সমস্যাটি ভালোভাবে অনুধাবন করে সম্ভব হলে অন্যান্য অজ্ঞাত রাশিগুলোকেও একই চলক এর মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে।

৩. সমস্যাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করে বীজগাণিতিক রাশি দ্বারা প্রকাশ করতে হবে।

৪. প্রদত্ত শর্ত ব্যবহার করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলোকে একত্রে একটি সমীকরণে প্রকাশ করতে হবে

৫. সমীকরণটি সমাধান করে অজ্ঞাত রাশি x এর মান নির্ণয় করতে হবে।

 

বাস্তব সমস্যা সমাধানে বীজগাণিতিক সূত্র গঠন ও প্রয়োগ

 

বাস্তব সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন সূত্র ব্যবহার করা হয়। সূত্রগুলো এখানে আলোচনা করা হলো

দেয় বা প্রাপ্য বিষয়ক

মনে করি,

q = জনপ্রতি দেয় বা প্রাপ্য টাকার পরিমাণ

n = লোকের সংখ্যা

দেয় বা প্রাপ্য টাকার পরিমাণ, A = qn

সময় ও কাজ বিষয়ক

মনে করি,

q = প্রত্যেকে একক সময়ে কাজের যে অংশ সম্পন্ন করে

n = কাজ সম্পাদনকারীর সংখ্যা

x = কাজের মোট সময়

W = n জনে x সময়ে কাজের যে অংশ সম্পন্ন করে

W = qnx

সময় ও দূরত্ব বিষয়ক

মনে করি,

v = প্রতি ঘণ্টায় গতিবেগ

t = মোট সময়

d = মোট দূরত্ব

d = vt

নল ও চৌবাচ্চা বিষয়ক

মনে করি,

Qo = নলের মুখ খুলে দেওয়ার সময় চৌবাচ্চায় জমা পানির পরিমাণ

q = প্রতি একক সময়ে নল দিয়ে যে পানি প্রবেশ করে অথবা বের হয়

t = অতিক্রান্ত সময়

Q(t) = t সময়ে চৌবাচ্চায় পানির পরিমাণ

Q(t) = Qo±qt

পানি প্রবেশ হওয়ার শর্তে ‘+’ চিহ্ন এবং পানি বের হওয়ার শর্তে ‘-‘ চিহ্ন ব্যবহার করতে হবে।

 

বাস্তব সমস্যা সমাধানে বীজগাণিতিক সূত্র গঠন ও প্রয়োগ

 

শতকরা অংশ বিষয়ক

মনে করি,

b = মোট রাশি

r = শতকরা হার = s/100 = s%

p = শতকরা অংশ = b এর s%

p = br

লাভ-ক্ষতি বিষয়ক

মনে করি, C = ক্রয়মূল্য

r = লাভ বা ক্ষতির শতকরা হার

বিক্রয়মূল্য S = C (1±r)

লাভের ক্ষেত্রে, S = C(1 + r) এবং ক্ষতির ক্ষেত্রে, S = C(1 – r)

বিনিয়োগ-মুনাফা বিষয়ক

মনে করি,

I  = n একক সময় পরে মুনাফা

n = নির্দিষ্ট সংখ্যক একক সময়

P = মূলধনের পরিমাণ

r = একক সময়ে একক মূলধনের মুনাফা

A = n একক সময় পরে মুনাফাসহ মূলধন

সরল মুনাফার ক্ষেত্রে,

I = Pnr

A=P+I=P+ Pnr = P(1+ nr)

চক্রবৃদ্ধি মুনাফার ক্ষেত্রে, C = P(1+r)n

উদাহরণ ৩৪.

বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান করার জন্য কোনো এক সমিতির সদস্যরা 45,000 টাকার বাজেট করলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন যে, প্রত্যেক সদস্যই সমান চাঁদা দিবেন। কিন্তু 5 জন সদস্য চাঁদা দিতে অসম্মতি জানালেন। এর ফলে প্রত্যেক সদস্যের মাথাপিছু 15 টাকা চাঁদা বৃদ্ধি পেল। ঐ সমিতিতে কতজন সদস্য ছিলেন?

সমাধান:

মনে করি, সমিতির সদস্য সংখ্যা : এবং জনপ্রতি দেয় চাঁদার পরিমাণ q টাকা। তাহলে, মোট চাঁদা, A = qx = 45,000 টাকা।

প্রকৃতপক্ষে চাঁদা প্রদানকারী সদস্য সংখ্যা ছিল (x – 5) জন এবং জনপ্রতি চাঁদা (q + 15) টাকা।

তাহলে, মোট চাঁদা হলো (x – 5) (q +15 )

প্রশ্নানুসারে,

qx=(x-5)(q+15) ……………(1)

qx= 45000 ………… (2)

সমীকরণ (1) থেকে পাই,

qx=(x-5)(q+15)

বা, qx=qx5q+15x-75

বা,5q= 15×75 = 5(3x-15)

q=3x-15

সমীকরণ (2) এ g এর মান বসিয়ে পাই,

(3×15) x x 45000

বা, 3x²-15x = 45000

বা, x2 – 5x = 15000 [উভয়পক্ষকে 3 দ্বারা ভাগ করে]

বা,x25x15000 = 0

বা, x²-125x+120×150000

বা, x(x125) + 120(x – 125) = 0

বা, (x125)(x+120) = 0

বা, (125) = 0 (x + 120) = 0

বা, x = 125,x = -120

যেহেতু সদস্য সংখ্যা ঋণাত্মক হতে পারে না, তাই x এর মান – 120 গ্রহণযোগ্য নয়।

সুতরাং, সমিতির সদস্য সংখ্যা 125

 

বাস্তব সমস্যা সমাধানে বীজগাণিতিক সূত্র গঠন ও প্রয়োগ

 

উদাহরণ ৩৫.

রফিক একটি কাজ 10 দিনে করতে পারে। শফিক ঐ কাজ 15 দিনে করতে পারে। তারা একত্রে কত দিনে কাজটি শেষ করতে পারবে?

সমাধান:

মনে করি, তারা একত্রে d দিনে কাজটি শেষ করতে পারবে।

নাম

কাজ সম্পন্ন করার দিন

১ দিনে কাজের সম্পন্ন অংশ

d দিনে কাজের সম্পন্ন অংশ

রফিক

10

1/10

d/10

শফিক

15

1/15

d/15

প্রশ্নানুসারে, d/10 +  d/15 = 1

বা, d (1/10 + 1/15) = 1

বা, d( (3+2)/30) = 1

বা, 5d/30 = 1

বা, d = 30/5 = 6

সুতরাং, তারা একত্রে 6 দিনে কাজটি শেষ করতে পারবে।

উদাহরণ ৩৬.

একজন মাঝি স্রোতের প্রতিকূলে t1 ঘণ্টায় কি.মি. যেতে পারে। স্রোতের অনুকূলে I ঐ পথ যেতে তার t2 ঘণ্টা লাগে। স্রোতের বেগ ও নৌকার বেগ কত?

সমাধান:

ধরি, স্রোতের বেগ ঘণ্টায় কি.মি. এবং স্থির পানিতে নৌকার বেগ ঘণ্টায় কি.মি.। তাহলে, স্রোতের অনুকূলে নৌকার কার্যকরী বেগ ঘণ্টায় (u + 2) কি.মি. এবং স্রোতের প্রতিকূলে নৌকার কার্যকরী বেগ ঘণ্টায় (u – 1 ) কি.মি.।

আমরা জানি, বেগ = অতিক্রান্ত দূরত্ব সময়

প্রশ্নানুসারে, u + v = x/t2 ……… (1)

এবং u – v = x/t1 ………… (2)

সমীকরণ (1) ও (2) যোগ করে পাই,

2u =  x/t2 + x/t1 = x( 1/t1 + x/t2)

বা, u = x/2( 1/t1 + x/t2)

সমীকরণ (1) ও (2) বিয়োগ করে পাই,

2v = x/t2 – x/t1 = x( 1/t2 – x/t1)

বা, v = x/2( 1/t2 – x/t1)

সুতরাং, স্রোতের বেগ ঘণ্টায় x/2( 1/t2 – x/t1) কি.মি. এবং নৌকার বেগ ঘণ্টায় x/2( 1/t1 + x/t2) কি.মি.।

 

বাস্তব সমস্যা সমাধানে বীজগাণিতিক সূত্র গঠন ও প্রয়োগ

 

উদাহরণ ৩৭.

একটি নল 12 মিনিটে একটি খালি চৌবাচ্চা পূর্ণ করতে পারে। অপর একটি নল প্রতি মিনিটে 14 লিটার পানি বের করে দেয়। চৌবাচ্চাটি খালি থাকা অবস্থায় দুইটি নল একসাথে খুলে দেওয়া হলে চৌবাচ্চাটি 96 মিনিটে পূর্ণ হয়। চৌবাচ্চাটিতে কত লিটার পানি ধরে?

সমাধান:

মনে করি, প্রথম নল দ্বারা প্রতি মিনিটে লিটার পানি প্রবেশ করে এবং চৌবাচ্চাটিতে মোট লিটার পানি ধরে।

প্রশ্নানুসারে, প্রথম নল দ্বারা 12 মিনিটে খালি চৌবাচ্চাটি পূর্ণ হয়

y = 12x ……………… (1)

আবার, দুইটি নল দ্বারা 96 মিনিটে খালি চৌবাচ্চা পূর্ণ হয়

y = 96x – 96 x 14 …………… (2)

সমীকরণ (1) থেকে পাই, x = y/12

x এর মান সমীকরণ (2) এ বসিয়ে পাই,

y = 96 x – y/12 – 96 x 14

বা, y = 8y – 96 x 14

বা, 7y = 96 x 14

বা, y = (96 × 14)/ 7 = 192

সুতরাং, চৌবাচ্চাটিতে মোট 192 লিটার পানি ধরে।

উদাহরণ ৩৮.

একটি বইয়ের মূল্য 24 টাকা। এই মূল্য বই তৈরির ব্যয়ের 80% । বাকি মূল্য সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকেন। সরকার প্রতি বইয়ে কত টাকা ভর্তুকি দেন?

সমাধান:

বাজার মূল্য = বই তৈরির ব্যয়ের 80%

আমরা জানি, p = br

এখানে, p = 24 টাকা এবং r = = 80% = 80/100

24 = b x 80/100

বা, b (24 x 100)/ 80

b = 30 টাকা

সুতরাং বই তৈরির ব্যয় 30 টাকা।

:: ভর্তুকি = (30 – 24) টাকা = 6 টাকা

সুতরাং সরকার প্রতি বইয়ে 6 টাকা ভর্তুকি দেন ।

 

বাস্তব সমস্যা সমাধানে বীজগাণিতিক সূত্র গঠন ও প্রয়োগ

 

উদাহরণ ৩৯

টাকায় n সংখ্যক কমলা বিক্রয় করায় r% ক্ষতি হয়। ৪% লাভ করতে হলে, টাকায় কয়টি কমলা বিক্রয় করতে হবে?

সমাধান:

ক্রয়মূল্য 100 টাকা হলে, r% ক্ষতিতে বিক্রয়মূল্য (100 – r) টাকা।

তাহলে, যখন বিক্রয়মূল্য (100 – r) টাকা, তখন ক্রয়মূল্য 100 টাকা।

যখন বিক্রয়মূল্য 1 টাকা, তখন ক্রয়মূল্য 100/(100-r)  টাকা ।

আবার, ক্রয়মুল্য 100 টাকা হলে, s% লাভে বিক্রয়মূল্য (100 + s) টাকা।

ক্রয়মূল্য 100/(100-r) টাকা হলে, s% লাভে বিক্রয়মূল্য {(100 + s)/100 + 100/(100-r)} টাকা

(100 + s)/(100-r) টাকা ।

সুতরাং, (100 + s)/(100-r) টাকায় বিক্রয় করতে হবে n সংখ্যক কমলা

1 টাকায় বিক্রয় করতে হবে n x (100-r)/(100 + s) সংখ্যক কমলা

সুতরাং, টাকায় n (100-r)/(100 + s) সংখ্যক কমলা বিক্রয় করতে হবে।

উদাহরণ ৪০.

শতকরা বার্ষিক 7 টাকা হার সরল মুনাফায় 650 টাকার 6 বছরের মুনাফা কত?

সমাধান:

আমরা জানি, I = Pnr

এখানে, P = 650 টাকা, n = 6 বছর, শতকরা মুনাফার হার s = 7 টাকা

r = s/100 = 7/100

I = 650 x 6 x 7/100 = 273

সুতরাং, মুনাফা 273 টাকা।

উদাহরণ ৪১.

বার্ষিক শতকরা 6 টাকা হার চক্রবৃদ্ধি মুনাফায় 15000 টাকার 3 বছরের সবৃদ্ধিমূল ও চক্রবৃদ্ধি মুনাফা নির্ণয় কর।

সমাধান:

আমরা জানি, C = P(1 + r)n [যেখানে C চক্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবৃদ্ধিমূল]

দেওয়া আছে, P = 15000 টাকা, r = 6%= 6/100 n = 3 বছর

.:. C = 15000 (1+6/100)3 = 15000 (1+3/50) = 15000( 53/50)

= 15000 × ( 53/50) × ( 53/50) × ( 53/50)

সবৃদ্ধিমূল = 17865.24 টাকা

.:. চক্রবৃদ্ধি মুনাফা = (17865.24 – 15000 ) টাকা = 2865.24 টাকা।

 

বাস্তব সমস্যা সমাধানে বীজগাণিতিক সূত্র গঠন ও প্রয়োগ

 

উদাহরণ ৪২

টাকায় 10 টি আইসক্রিম এর কাঠি বিক্রয় করলে x% ক্ষতি হয়। টাকায় কয়টি বিক্রয় করলে ২% লাভ হবে?

সমাধান:

ক্রয়মূল্য 100 টাকা হলে x% ক্ষতিতে বিক্রয়মূল্য = (100 – x)

বিক্রয়মূল্য (100 – x) টাকা হলে ক্রয়মূল্য 100 টাকা

বিক্রয়মূল্য 1 টাকা হলে ক্রয়মূল্য 100/(100 – x) টাকা

অর্থাৎ 10 টি আইসক্রিম কাঠির ক্রয়মূল্য 100/(100 – x) টাকা

.:. 1 টি আইসক্রিম কাঠির ক্রয়মূল্য 100/(100 – x) x 10 টাকা

আবার ক্রয়মূল্য 100 টাকা হলে ২% লাভে বিক্রয়মূল্য (100 + z) টাকা

ক্রয়মূল্য 100 টাকা হলে বিক্রয়মূল্য (100 + z) টাকা

ক্রয়মূল্য 1 টাকা হলে বিক্রয়মূল্য (100 + z)/100

ক্রয়মূল্য 100 /(100 – x ) x 10 টাকা হলে

বিক্রয়মূল্য (100+ z)/ 100 x 100/(100 – x) x 10 টাকা

= (100+ z)/(100 – x) x 10

1 টি আইসক্রিম কাঠির বিক্রয়মূল্য (100+ z)/(100 – x) x 10 =  (100+ z)/(1000 – 10x) টাকা

অর্থাৎ টাকায় (1000 – 10x)/(100+ z) টি আইসক্রিম কাঠি বিক্রয় করতে হবে।

google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment