আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় দশমিক (Decimal) সংখ্যা পদ্ধতির গল্প – যা সংখ্যার গল্প এর অন্তর্ভুক্ত। গণিতে সংখ্যা ও অন্যান্য পরিমাপযোগ্য রাশিসমূহের মধ্যকার সম্পর্ক বর্ণনা করা হয়। গণিতবিদগন বিশৃঙ্খল ও অসমাধানযুক্ত সমস্যাকে শৃঙ্খলভাবে উপস্থাপনের প্রক্রিয়া খুঁজে বেড়ান ও তা সমাধানে নতুন ধারণা প্রদান করে থাকেন। গাণিতিক প্রমাণের মাধ্যমে এই ধারণাগুলির সত্যতা যাচাই করা হয়। গাণিতিক সমস্যা সমাধান সম্পর্কিত গবেষণায় বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ বা শত শত বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। গণিতের সার্বজনীন ভাষা ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা একে অপরের সাথে ধারণার আদান-প্রদান করেন। গণিত তাই বিজ্ঞানের ভাষা।
দশমিক (Decimal) সংখ্যা পদ্ধতির গল্প
০, ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ এই মোট দশটা চিহ্ন দিয়ে সংখ্যা তৈরি করার যে পদ্ধতিটা ভারতীয় উপমহাদেশের গণিতবিদ আর্যভট্ট বের করেছিলেন সেটিকে আমরা দশমিক সংখ্যা পদ্ধতি বলি।
চলো এবারে গল্পের মতো করেই শুনি কীভাবে আর্যভট্ট এই পদ্ধতির চিন্তা করেছিলেন।
আর্যভট্ট ভাবলেন, ‘আমি যদি সংখ্যাকে প্রকাশ করতে চাই তাহলে নিচের মতো করে প্রকাশ করব।’
এরপর উনি লিখলেন:
০ | ১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ |
এখন উনি ভাবলেন, ‘আমার কাছে যতগুলো চিহ্ন ছিল সব একবার করে লেখা শেষ। এখন যদি একটু খেয়াল করি তাহলে দেখব রোমান পদ্ধতির মতো প্রত্যেকটা সংখ্যা এক এক করে বাড়তে থাকে। অর্থাৎ ১ এর সাথে ১ যোগ করলে ২ পাব আবার ২ এর সাথে ১ যোগ করলে ৩ পাব। এখন যদি আমি আবার লিখতে থাকি তাহলে ৯ এর পরে কী লিখব।
১ম বার লেখা শেষ:
০ | ১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ |
০?? |
‘কিন্তু আমি যে সবগুলোর চিহ্ন একবার ব্যবহার করেছি সেটা তো সংখ্যায় লিখতে হবে। সেটা আমি কোথায় লিখব।’
০ | ১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ |
১০ |
সংখ্যাগুলো লিখা শেষ এটা বুঝাতে শুন্য লিখলাম এবং ১ লিখলাম প্রত্যেকটি সংখ্যার বাম পাশে কারণ একবার করে লেখা শেষ হয়েছে। এরপর তিনি বললেন, ‘শুধু ১ এবং ১০ এ০ এর বাম পাশের ১ কিন্তু একই অর্থ প্রকাশ করে না। অর্থাৎ এদের মান কিন্তু এক নয়। কারণ ১০ এ০ এর বাম পাশের ১ বলছে আমরা সবগুলো সংখ্যা একবার লিখে ফেলেছি। এখন যদি আমি আবার একবারের পর এভাবে লিখতে থাকি তাহলে কী হবে?’
০ | ১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ |
১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ |
২০ | ২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ | ২৮ | ২৯ |
এখানে ২০ এর ২ আর ১২ এর ২ কিংবা শুধু ২ এর মান কিন্তু একই না। আমরা যখন রোমান সংখ্যায় XX লিখি তাহলে ১০ আর ১০ যোগ করে ২০ বুঝাচ্ছি কিন্তু আমাদের এই নিয়মে ১০ লিখলে ১ আর ০ যোগ করে কিন্তু ১ বুঝাচ্ছে না। তিনি কিন্তু তখনও এইসব সংখ্যার নাম দেননি। তিনি বুঝালেন যে আমি সবগুলো প্রতীক কতবার লিখছি সেটা বুঝানোর জন্য সেই সংখ্যাটা বসাচ্ছি। এভাবে তিনি কত পর্যন্ত লিখতে পারবেন?
তাহলে যে ৯টি প্রতীক আছে সবগুলো দিয়ে দুইবার যদি নানাভাবে লিখি তাহলে আমরা ৯৯ পর্যন্ত লিখতে পারবো। এরপর উনি আবার আটকে গেলেন যে এরপর কী করা যায়। এরপর তিনি চিন্তা করলেন এই পদ্ধতিতে যে সংখ্যা পর্যন্ত লিখলাম তাকে আরেকবার লিখি। অর্থাৎ আরেকবার লিখতে হলে আমাদের আবার ০ থেকে শুরু করতে হবে এবং সেটা আমাকে বলতে হবে।
৯৯ / 0 ৯৯/০০ ৯৯/১০০
এরপর আমরা যদি খেয়াল করি উপরে লেখা বামের অঙ্কগুলোতে, তাহলে দেখব, সেখানেও আমরা একবার করে ৯ বার সবগুলো প্রতীক লিখে ফেলেছি। অতএব আমাকে আরেকটা শূন্য বসাতে হবে। এখন আর বাম পাশে যদি ১ লিখি তাহলে, এই ১০০ এর বাম পাশের ১ কিন্তু দুই অঙ্কের সংখ্যার বামের সংখ্যাগুলো কয়বার লেখা হয়েছে তা প্রকাশ করছে। কিন্তু দুই অঙ্কের সংখ্যার ডান পাশের সংখ্যাগুলো কী দিয়ে প্রকাশ করছে?
এরপর একটি নাম দিলেন। এরপর তিনি দুই অঙ্কের সংখ্যার বামের সংখ্যাটিকে দশক এবং তিন সংখ্যার বামের সংখ্যাটিকে শতক বলে নাম দেন। অর্থাৎ আমরা যদি দেখি প্রথম ১ টার দশ গুণ হয়ে গেলো ১০ এবং ১০ এর দশ গুণ হয়ে গেলো ১০০। এখান থেকে একটি চমৎকার জিনিস উনি খেয়াল করলেন যে, ‘আমি যদি সংখ্যাগুলোকে পাশাপাশি লিখতে থাকি এবং আমি এক স্থান থেকে আরেক স্থানে আসি তবে সংখ্যাটা ১০ গুণ বাড়ে।
এখন কিন্তু আমরা শিখে ফেললাম এবং তিন সংখ্যায় আমি ৯৯৯ পর্যন্ত লিখতে পারবো এবং এর পর আরও আবার এক ঘর বামে বাড়বে। এভাবে যতবার স্থানের পরিবর্তন হবে ততবার ১০ গুণ হয়ে বাড়তে থাকবে। এভাবে গণনার চিন্তা থেকেই আসলে দশমিক পদ্ধতিটা আসলো। আমরা যদি এখন দেখি যে প্রত্যেক বার স্থান পরিবর্তনে ১০ গুণ করে বেড়ে যাচ্ছে এবং সেইটাই সংখ্যা পদ্ধতি। আমাদের হাতের ১০টি আঙ্গুল দিয়ে ০ থেকে ৯ পর্যন্ত এই দশটা চিহ্ন বা প্রতীককে দেখানো বা প্রকাশ করা যায়।
তাহলে আমাদের সংখ্যা পদ্ধতিতে ১০ টা চিহ্ন বা প্রতীক রয়েছে যার বাংলায় একটা নাম দিলাম অঙ্ক আর ইংরেজিতে একটা নাম দিলাম ডিজিট (Digit)
আমরা এইযে ১ – ৯ পর্যন্ত সংখ্যা দেখছি ওরা নিজেরাই একটা কিছু প্রকাশ করে অর্থাৎ ওদের দাম আছে। তবে এককভাবে ০ এর কোনো দাম বা মূল্য নেই তাই ০ কে অন্য কোনো সংখ্যার সঙ্গে থাকতে হয়। এজন্য ০ কে বলা হয় সহকারী বা ইংরেজিতে auxiliary আর ১-৯ পর্যন্ত সংখ্যাগুলোকে বলা হয় সার্থক অঙ্ক বা ইংরেজিতে significant number আমরা আগে রোমান সংখ্যার কথার সময় বলেছিলাম XX বা XC এভাবে পাশপাশি সংখ্যা লেখাকে বলা সংখ্যা পাতন বা notation। কোনো সংখ্যা যদি আমরা লিখতে চাই তাহলে আমরা ০-৯ এই চিহ্নগুলোকে একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে লিখবো যে পদ্ধতিতে প্রতিবার যখন সংখ্যাটা বাম দিকে আসবে তখন সেটা তার থেকে ১০ গুণ বেড়ে যাবে।
তাহলে এখন আমরা দেখি,
একটি সংখ্যা ১২৩
এখানে তিনটি অঙ্ক আছে এবং তিনি ডান থেকে একক, দশক, শতক এভাবে প্রতিটির একটি করে নাম দিয়েছেন।’
১ | ২ | ৩ |
শতক | দশক | একক |
এটা পড়ার সময় আমাদের পড়তে হবে: ১ শতক ২ দশক ৩ একক। সংখ্যাটার সত্যিকারের মান হবে: একটা শতক (১০০) + দুইটা দশক (২০) তিনটা একক (৩) একশত তেইশ (১২৩)। এভাবে আমরা সংখ্যাগুলো লিখতে শুরু করলাম এবং লেখার ফলে কিন্তু আমরা দশমিক পদ্ধতি পেয়ে গেলাম।
কাগজের ভাঁজে লুকানো স্থানীয় মান
দেশীয় রীতি
লক্ষ | হাজার |
শতক
|
দশক
|
একক
|
|||
কোটি | নিযুত | লক্ষ | অযুত | হাজার | |||
অষ্টম | সপ্তম | ষষ্ঠ | পঞ্চম | চতুর্থ | তৃতীয় | দ্বিতীয় | প্রথম |
১ | ৩ | ০ | ৮ | ২ | ৫ | ২ | 8 |
এক কোটি ত্রিশ লক্ষ বিরাশি হাজার পাঁচশত চব্বিশ
আন্তর্জাতিক রীতি
দুইশত চুয়ালিশ বিলিয়ন দুইশত তেরো মিলিয়ন বিরাশি হাজার পাঁচশত চব্বিশ
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রীতির তুলনা
লক্ষ | হাজার | ||||||||||
? | ? | ? | ? | কোটি | নিযুত | লক্ষ | অযুত | হাজার | শতক | দশক | একক |
দ্বাদশ তম | সপ্তম | দশম | নবম | অষ্টম | সপ্তম | ষষ্ঠ | পঞ্চম | চতুর্থ | তৃতীয় | দ্বিতীয় | প্রথম |
উপরের সংখ্যাটিকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় রীতিতে প্রকাশ করো।
দেশীয় রীতিতে কোটির উপরে আরও কিছু কি আছে? খুঁজে বের করার দায়িত্ব তোমাদের। তোমাদের শিক্ষক, অভিভাবক, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু সবার সাথে আলোচনা করতে পার।
জোড়ায় কাজ
- প্রতি জোড়ায় ০, ১, ২,…, ৯ অঙ্কগুলি পুনরাবৃত্তিসহ লিখে মোট ১৬ টি কাগজের টুকরা তৈরি করো। নিচে একটি নমুনা দেওয়া হলো
০ | ১ | ১ | ২ |
৩ | ৫ | ৬ | ৭ |
৪ | ৮ | ৮ | ৯ |
২ | ৬ | ০ | ৮ |
- এবার প্রতি জোড়ায় তৈরি করা ১৬ টুকরা কাগজ থেকে লটারির মাধ্যমে জোড়ার প্রত্যেকে ৮টি করে কাগজের টুকরা নাও।
- এরপর জোড়ার প্রত্যেক শিক্ষার্থী লটারিতে প্রাপ্ত ৮টি কাগজের টুকরায় সাজিয়ে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সংখ্যা তৈরি করে খাতায় লিখো।
- এবার জোড়ার দুজনের সর্বোচ্চ সংখ্যা দুটির মধ্যে যার সংখ্যাটি বৃহত্তর হবে সে ১ পয়েন্ট পাবে অন্যজন ০ পয়েন্ট পাবে।’
- এবার জোড়ার দুজন শিক্ষার্থীর সর্বনিম্ন সংখ্যা দুটির মধ্যে যার সংখ্যাটি ক্ষুদ্রতর হবে সে ১ পয়েন্ট পাবে অন্যজন ০ পয়েন্ট পাবে।
- যার মোট পয়েন্ট বেশি হবে সে বিজয়ী হবে, পয়েন্ট সমান হলে খেলা ড্র হবে।
আরও দেখুনঃ